Top Post

ব্লু ওশান স্ট্রেটিজি ও রেড ওশান স্ট্রেটিজি : ব্যবসায় সফল হতে যে বিষয়টা জানা উচিত


 

ব্লু ওশান স্ট্র্যাটেজি এমন একটি কৌশল যেখানে ব্যবসাগুলো প্রতিযোগিতার চেয়ে নতুন বাজার তৈরি করে। এর মাধ্যমে এমন জায়গায় ব্যবসা করা হয় যেখানে কম প্রতিযোগিতা থাকে এবং নতুন গ্রাহকদের আকৃষ্ট করা যায়। নিচে আপনার উল্লেখিত প্রতিটি পয়েন্ট বাংলায় ব্যাখ্যা করছি এবং ব্লু ওশান কৌশলে এগুলো কিভাবে ব্যবহার করতে পারেন তা তুলে ধরছি।

১. ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি প্রটেকশন (বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির সুরক্ষা)

  • ব্যাখ্যা: পেটেন্ট, কপিরাইট এবং ট্রেডমার্কের মাধ্যমে আপনার উদ্ভাবন বা ডিজাইন সুরক্ষিত রাখা যায়।
  • ব্লু ওশান কৌশল: আপনার পণ্যের অনন্য বৈশিষ্ট্য সুরক্ষিত রাখতে IP ব্যবহার করুন। এতে প্রতিযোগীরা সহজে নকল করতে পারবে না এবং নতুন বাজারে আপনার পণ্য আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে।

২. পেটেন্ট এবং লাইসেন্স

  • ব্যাখ্যা: পেটেন্টের মাধ্যমে নতুন উদ্ভাবন রক্ষা করা হয় এবং লাইসেন্সের মাধ্যমে তা ব্যবহার করে মুনাফা করা যায়।
  • ব্লু ওশান কৌশল: নতুন পণ্য বা প্রসেসের জন্য পেটেন্ট নিন এবং লাইসেন্সের মাধ্যমে অন্য প্রতিষ্ঠানকে এটি ব্যবহারের অনুমতি দিন। এতে আপনি নতুন বাজারে প্রবেশ করতে পারবেন এবং প্রতিযোগিতাকে এড়াতে পারবেন।

৩. ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক (বিতরণ নেটওয়ার্ক)

  • ব্যাখ্যা: শক্তিশালী বিতরণ নেটওয়ার্ক আপনাকে দ্রুত এবং কার্যকরভাবে গ্রাহকদের কাছে পণ্য পৌঁছে দিতে সহায়তা করে।
  • ব্লু ওশান কৌশল: প্রচলিত বিতরণ চ্যানেল এড়িয়ে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম বা সরাসরি ভোক্তা মডেল ব্যবহার করুন। এতে আপনি নতুন গ্রাহক শ্রেণী আকর্ষণ করতে পারবেন।

৪. এক্সক্লুসিভ রাইটস (বিশেষাধিকার)

  • ব্যাখ্যা: এক্সক্লুসিভ চুক্তি বা সরবরাহের অধিকার প্রতিযোগিতার সংখ্যা কমিয়ে দেয়।
  • ব্লু ওশান কৌশল: উদীয়মান বাজারে সরবরাহকারী বা স্থানীয় ব্র্যান্ডের সঙ্গে এক্সক্লুসিভ চুক্তি করুন। এতে আপনি প্রতিযোগিতামুক্ত একটি বাজার দখল করতে পারবেন।

৫. ইকোনমিজ অফ স্কেল (পণ্যের পরিমাণের উপর ভিত্তি করে খরচ কমানো)

  • ব্যাখ্যা: পণ্যের পরিমাণ বাড়ানোর ফলে উৎপাদন খরচ কমে, যা আপনাকে দাম কমাতে সহায়তা করে।
  • ব্লু ওশান কৌশল: ইকোনমিজ অফ স্কেল ব্যবহার করে নতুন পণ্য কম দামে বাজারজাত করুন। এতে প্রতিযোগীরা সহজে দাম মিলাতে পারবে না এবং আপনি নতুন বাজারে গ্রাহক আকৃষ্ট করতে পারবেন।

৬. উচ্চ মূলধন বিনিয়োগ

  • ব্যাখ্যা: উচ্চ মূলধন বিনিয়োগ প্রতিযোগীদের বাজারে প্রবেশ করা কঠিন করে তোলে।
  • ব্লু ওশান কৌশল: R&D এবং প্রযুক্তিতে বড় বিনিয়োগ করুন যাতে আপনি এমন একটি পণ্য বা পরিষেবা তৈরি করতে পারেন যা প্রচলিত বাজারে নেই।

৭. প্রোপ্রাইটারি টেকনোলজি (নিজস্ব প্রযুক্তি)

  • ব্যাখ্যা: নিজস্ব প্রযুক্তি আপনাকে একটি অনন্য মূল্য প্রস্তাব দেয় এবং গ্রাহকদের আপনার ইকোসিস্টেমের মধ্যে আটকে রাখে (যেমন, উইন্ডোজ OS)।
  • ব্লু ওশান কৌশল: গ্রাহকদের জন্য অনন্য অভিজ্ঞতা দেওয়ার জন্য নিজস্ব প্রযুক্তি তৈরি করুন। এটি প্রতিযোগীদের থেকে নিজেকে আলাদা করতে সাহায্য করে এবং নতুন বাজার তৈরি করতে সহায়ক হয়।

৮. এক্সসেলেন্ট কাস্টমার সার্ভিস (উত্তম গ্রাহক সেবা)

  • ব্যাখ্যা: অসাধারণ গ্রাহক সেবা গ্রাহকদের সন্তুষ্টি বাড়ায় এবং তাদের লয়াল্টি বৃদ্ধি করে।
  • ব্লু ওশান কৌশল: গ্রাহকদের জন্য এমন সেবা প্রদান করুন যা বাজারের অন্যান্য সেবাগুলোর চেয়ে অনেক ভালো। উদাহরণস্বরূপ, ২৪/৭ ব্যক্তিগত কাস্টমার সাপোর্ট সরবরাহ করতে পারেন, যা নতুন বাজার তৈরি করতে সহায়তা করবে।

৯. ব্র্যান্ড ইক্যুইটি (ব্র্যান্ড মূল্য)

  • ব্যাখ্যা: শক্তিশালী ব্র্যান্ড ইক্যুইটি আপনাকে উচ্চমূল্যে পণ্য বিক্রি করতে এবং গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতে সহায়তা করে।
  • ব্লু ওশান কৌশল: ব্র্যান্ড ইক্যুইটিকে ব্যবহার করে নতুন উদ্ভাবনী পণ্য চালু করুন যা আপনার ব্র্যান্ডের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী। উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনার ব্র্যান্ড পরিবেশবান্ধব পণ্যের জন্য পরিচিত হয়, তবে একটি নতুন ইকো-ফ্রেন্ডলি লাইন চালু করতে পারেন।

১০. লয়ালটি বিয়ন্ড লজিক (যুক্তির বাইরে লয়াল্টি)

  • ব্যাখ্যা: গ্রাহকরা আপনার ব্র্যান্ডের প্রতি এতটাই অনুগত থাকে যে, তারা সস্তা বা ভালো বিকল্প থাকলেও আপনার পণ্যই কিনে।
  • ব্লু ওশান কৌশল: গ্রাহকদের সাথে আবেগপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করুন। স্টোরিটেলিং, কমিউনিটি বিল্ডিং, এবং অনন্য ব্র্যান্ড অভিজ্ঞতা প্রদান করে এমন একটি বাজার তৈরি করুন যেখানে প্রতিযোগীরা সহজে প্রবেশ করতে পারবে না। উদাহরণস্বরূপ, অ্যাপলের মতো ব্র্যান্ড ভক্তদের একটি কমিউনিটি তৈরি করে, যারা যুক্তির বাইরেও অনুগত থাকে।

ব্লু ওশান কৌশলে এই উপাদানগুলো ব্যবহার করার পদ্ধতি:

  1. উদ্ভাবন এবং ভিন্নতা আনা: পেটেন্ট, নিজস্ব প্রযুক্তি এবং এক্সক্লুসিভ রাইটস ব্যবহার করে এমন পণ্য তৈরি করুন যা প্রচলিত বাজারে নেই।
  2. খরচ কমানো এবং মূল্য বৃদ্ধি: ইকোনমিজ অফ স্কেল এবং শক্তিশালী বিতরণ নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে উচ্চমানের পণ্য কম দামে সরবরাহ করুন।
  3. আবেগপূর্ণ সংযোগ তৈরি করুন: ব্র্যান্ড ইক্যুইটি এবং চমৎকার গ্রাহক সেবা ব্যবহার করে গ্রাহকদের সাথে শক্তিশালী আবেগপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করুন।
  4. প্রবেশের বাধা তৈরি করুন: উচ্চ মূলধন বিনিয়োগ এবং IP সুরক্ষা প্রতিযোগীদের বাজারে প্রবেশ করা কঠিন করে তোলে।

এই কৌশলগুলো ব্যবহার করে আপনি প্রতিযোগিতামুক্ত বাজার তৈরি করতে পারবেন এবং গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতে পারবেন, যা ব্লু ওশান স্ট্র্যাটেজির মূল লক্ষ্য।

 

 

রেড ওশান স্ট্র্যাটেজি হল এমন একটি ব্যবসায়িক কৌশল যেখানে প্রতিযোগিতা সবচেয়ে বেশি এবং বাজার বেশ পরিপূর্ণ। এখানে ব্যবসাগুলো একই ধরনের পণ্য বা পরিষেবা সরবরাহ করে এবং মূল লক্ষ্য হয় প্রতিযোগীদের থেকে বেশি গ্রাহক অর্জন করা। রেড ওশান স্ট্র্যাটেজিতে প্রতিযোগিতা সরাসরি এবং বাজার দখলের জন্য প্রচণ্ড লড়াই হয়। এটি মূলত বাজারের বিদ্যমান চাহিদা পূরণে ফোকাস করে এবং উচ্চ প্রতিযোগিতার কারণে মুনাফা কমে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।

রেড ওশান স্ট্র্যাটেজির বৈশিষ্ট্য:

  1. প্রতিযোগিতার উপর ফোকাস

    • রেড ওশান স্ট্র্যাটেজিতে প্রতিযোগিতাকে হারিয়ে বাজারে টিকে থাকা গুরুত্বপূর্ণ। ব্যবসাগুলো প্রতিযোগীদের পণ্য ও মূল্যের সাথে মেলানোর চেষ্টা করে।
  2. বাজার দখলের লড়াই

    • এখানে বিদ্যমান চাহিদা পূরণ করা হয়, এবং একই ধরনের পণ্য বা পরিষেবার মাধ্যমে প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হয়।
  3. দাম কমানো এবং খরচ কমানো

    • দাম কমিয়ে এবং খরচ কমিয়ে বেশি বিক্রি করার চেষ্টা করা হয়। এটি গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতে সাহায্য করে, তবে লাভের পরিমাণ কমে যেতে পারে।
  4. কম ভিন্নতা

    • পণ্য বা পরিষেবাগুলো সাধারণত একই রকম হয়। উদাহরণস্বরূপ, মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো একে অপরের সাথে একই ধরনের ফিচার নিয়ে প্রতিযোগিতা করে।
  5. উন্নত প্রযুক্তি ও বিজ্ঞাপন কৌশল

    • প্রতিযোগিতা জিততে উন্নত প্রযুক্তি, প্রচারাভিযান, এবং বিজ্ঞাপনের ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়।
  6. বিদ্যমান বাজারে চাহিদা ক্যাপচার করা

    • নতুন বাজার তৈরি করার চেয়ে বিদ্যমান চাহিদা পূরণে ফোকাস করা হয়। ফলে প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হয়।

রেড ওশান স্ট্র্যাটেজির উদাহরণ:

  1. ফাস্ট ফুড ইন্ডাস্ট্রি

    • উদাহরণ: কেএফসি বনাম ম্যাকডোনাল্ডস। দুই কোম্পানিই প্রায় একই ধরনের ফাস্ট ফুড সরবরাহ করে এবং গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতে দাম কমানো বা নতুন অফার দেয়।
  2. স্মার্টফোন মার্কেট

    • উদাহরণ: স্যামসাং বনাম শাওমি। দুই ব্র্যান্ডই স্মার্টফোন বাজারে প্রতিযোগিতা করে এবং প্রতিনিয়ত নতুন মডেল ও ফিচার যোগ করে।
  3. এয়ারলাইন্স ইন্ডাস্ট্রি

    • উদাহরণ: বাজেট এয়ারলাইন্স কোম্পানিগুলো, যেমন ইন্ডিগো ও স্পাইসজেট। তারা কম দামে টিকিট অফার করে এবং প্রতিযোগীদের থেকে বেশি গ্রাহক আকৃষ্ট করতে চেষ্টা করে।

রেড ওশান স্ট্র্যাটেজির সুবিধা:

  1. বিদ্যমান চাহিদার ওপর নির্ভরতা

    • বাজারে চাহিদা ইতিমধ্যেই বিদ্যমান থাকায় নতুন চাহিদা তৈরি করার ঝুঁকি কম থাকে।
  2. প্রচলিত ব্যবসায়িক মডেল

    • প্রচলিত ব্যবসায়িক মডেল ব্যবহার করা সহজ হয় এবং কম ঝুঁকিপূর্ণ।
  3. ব্র্যান্ড সচেতনতা

    • প্রচলিত পণ্যের জন্য ব্র্যান্ড পরিচিতি সহজে তৈরি করা যায়, যেহেতু গ্রাহকরা পণ্য সম্পর্কে জানে।

রেড ওশান স্ট্র্যাটেজির অসুবিধা:

  1. মুনাফার কম হওয়া

    • প্রতিযোগিতা বেশি হওয়ার কারণে দাম কমাতে হয়, ফলে মুনাফার হার কমে যায়।
  2. ভিন্নতা কমানো

    • বাজারে প্রচুর প্রতিযোগী থাকার কারণে পণ্যে ভিন্নতা আনা কঠিন হয়।
  3. বাজারের সীমিত প্রবৃদ্ধি

    • রেড ওশান স্ট্র্যাটেজিতে বাজার ইতিমধ্যেই পূর্ণ থাকে, তাই প্রবৃদ্ধির সুযোগ কম থাকে।
  4. দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকার ঝুঁকি

    • প্রচুর প্রতিযোগী থাকার কারণে ব্যবসার দীর্ঘমেয়াদী স্থায়িত্ব ঝুঁকিতে পড়তে পারে।

রেড ওশান স্ট্র্যাটেজি থেকে বেরিয়ে আসার কৌশল:

  1. ভিন্নতা সৃষ্টি করুন:

    • পণ্য বা পরিষেবায় নতুনত্ব আনার চেষ্টা করুন, যা গ্রাহকদের জন্য আকর্ষণীয় হতে পারে।
  2. কাস্টমার এক্সপেরিয়েন্স উন্নত করুন:

    • গ্রাহকদের জন্য আরও ভালো অভিজ্ঞতা তৈরি করুন, যা প্রতিযোগীদের থেকে আপনাকে আলাদা করতে সহায়ক হবে।
  3. ব্লু ওশান স্ট্র্যাটেজিতে পরিবর্তন:

    • নতুন বাজার খুঁজে বের করুন এবং প্রতিযোগিতামুক্ত নতুন পণ্য বা পরিষেবা চালু করুন।

সারাংশ: রেড ওশান স্ট্র্যাটেজি অনুসরণ করলে প্রচলিত বাজারে প্রবেশ করতে সহজ হয়, তবে এর সাথে প্রচণ্ড প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হয়। ব্যবসায় দীর্ঘমেয়াদী টিকে থাকার জন্য ব্লু ওশান কৌশলের দিকে নজর দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, যা নতুন বাজার তৈরি এবং নতুন চাহিদা পূরণের ওপর জোর দেয়।

Post a Comment

Previous Post Next Post